সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন
♦অভিযোগ তদন্তে এডিসি জেনারেল, আজ শাল্লায় জরুরি সভা
♦দিরাইয়েরও তদন্ত হবে, অনিয়মকারীদের কোনো ছাড় নেই- জেলা প্রশাসক
সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লায় হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে (পিআইসি) দুদকের মামলার একাধিক আসামীকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের বাঁধের কাজে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় তারা এজাহারভুক্ত আসামী। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ সিলেটের ডাককে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, অভিযোগের সত্যতা পেলে ঐ পিআইসিগুলো বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, দুদকের আসামী কেন পিআইসিতে থাকবে। শাল্লায় আজ মঙ্গলবার জরুরি সভা আহবান করা হয়েছে। দিরাইয়েও সভা করা হবে। হাওরের বাঁধ নির্মাণে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি পিআইসি গঠন করা হয়। কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের এক মাসেরও পরে পিআইসি গঠন করা হলেও কমিটি গঠনে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ২০১৭ সালে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল দুদক আইনের সেইসব আসামীদেরকে এবারের পিআইসিতে দায়িত্ব দেয়া হয়। দৈনিক সিলেটের ডাক-এর অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।
চলতি পিআইসি তালিকা, দুদক আইনের মামলার এজাহার ও ২০১৭ সালের পিআইসির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউপি সদস্য প্রদীপ ভৌমিক, তাড়ল ইউপির সদস্য লাল মিয়া, জগদল ইউনিয়নের কলিয়ারকাপনের মিজানুর রহমান চৌধুরী ছোবা মিয়া, শাল্লা উপজেলার আটগাও ইউপি সদস্য বশির মিয়া ও আবুল মিয়া এবারের পিআইসিতে সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা সবাই ২০১৭ সালের দুদকের মামলার এজাহারভুক্ত আসামী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমে গোপনে রাজনৈতিক নেতারা পিআইসি তৈরি করে অনুমোদনের জন্যে উপজেলা কমিটির নিকট তুলে দেন। উপজেলা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের পর পিআইসির সভাপতি-সম্পাদকের নামের তালিকা প্রকাশের পরই চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়। এক পর্যায়ে আটগাঁও ইউপির সদস্য বশির মিয়া ও আবুল মিয়ার বিরুদ্ধে গত রোববার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের নিকট একাধিক অভিযোগ দেয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, দুদকের মামলা চলমান থাকা অবস্থায় চলতি বছর ২০১৯ সালে পুনরায় তাদেরকে পিআইসির সভাপতি করা হয়। এতে করে পুনরায় সরকারি অর্থ আত্মসাতের সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথক অভিযোগের খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। কেবল শাল্লায়ই নয় একই ঘটনা দিরাইয়েও ঘটেছে।
শাল্লার আটগাঁও ইউপি সদস্য আবুল মিয়া ৬৪ নং পিআইসির সভাপতি। তার পিআইসির বরাদ্দ ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকারও বেশি। এই তথ্য আবুল মিয়া নিজেই সিলেটের ডাককে জানিয়ে বলেন, দুদকের আসামী ঠিক; কিন্তু আমিতো সাজাপ্রাপ্ত নই। হবিবপুর ইউনিয়নের শিথিল মেম্বার-সুব্রত মেম্বারও তো দুদকের আসামী। তারাও তো এবার পিআইসি পেয়েছে। দিরাইয়ের চরনারচর ইউনিয়নেও তো দুদকের আসামী পিআইসির কাজ করছেন। তার মতে, এতে দোষের কিছু নেই।
একই ইউনিয়নের অপর সদস্য বশর মিয়া দাবি করেন তিনি দুদকের মামলার আসামী নন। অথচ দুদক আইনের মামলার এজাহারের ৭৫নং আসামী তিনি। তিনি ২০১৭ সালের ২১০ নং পিআইসির সভাপতি ছিলেন।
এদিকে, দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের সদস্য প্রদীপ ভৌমিক এবার দিরাই উপজেলার ৫২নং পিআইসির সভাপতি। এই পিআইসির বরাদ্দ ১৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। দুদকের মামলার এজাহারের ৬৩নং আসামী প্রদীপ ভৌমিক বলেন, ২০১৭ সালের কাজের ঘটনায় আসামী হয়েছিলাম বলে গতবার কাজ দেয়া হয়নি। বর্তমানে মামলাটি চলছে।
তাড়ল ইউনিয়নের সদস্য লাল মিয়া ১২নং পিআইসির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। এই পিআইসির বরাদ্দ ২১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৬ টাকা। ২০১৭ সালের মামলার এজাহারের ১১নং আসামী তিনি। তবে লাল মিয়া দাবি করেন, মামলাটি শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি এই মামলায় নেই।
জগদল ইউনিয়নের কলিয়ারকাপনের মিজানুর রহমান চৌধুরী ৮৬নং পিআইসির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। তার প্রকল্পের বরাদ্দ ১৬ লাখ ১০ হাজার ৯ টাকা। তিনিও ২০১৭ সালের মামলার এজাহারের ১০নং আসামী। ২০১৭ সালের ১৬৫নং পিআইসির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের কাজ শতভাগ হওয়ার পরও দুদকের মামলা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বর্তমানে সম্ভবত মামলাটি স্থগিত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে এ রকম কিছু হয় নাই। আমি এখানে রিসেন্টলি এসেছি-২০১৭ সালে কারা আসামী ছিল তা আমার জানা নেই। উপজেলা কমিটির সমন্বয়ে পিআইসি হয়েছে। কেউ কিছুতো বলে নাই।’
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-মুক্তাদির হোসেন রোববার রাতে সিলেটের ডাককে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। জেনে বলতে হবে। আমার কাছে কেউ অভিযোগও করেনি। দেখি-কথা বলি তারপর বলতে পারব।’
‘হাওর বাঁচাও-সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, যারা পিআইসির কাজ করে দুদকের আসামী হলো তাদেরকেই আবার পিআইসির দায়িত্ব দেয়া হলো-যা দুঃখজনক। বিষয়টির ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ নেই। না হয় ২০১৭ সালের মতো এবারও লুটপাট হতে পারে। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। অথচ হাওরবাসীর জন্যে প্রধানমন্ত্রী কতো আন্তরিক তা আমরা দেখেছি। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরাও রাস্তায় নামবো।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আব্দুল আহাদ বলেন, শাল্লার ব্যাপারে অভিযোগ আসার পরই এডিসি জেনারেলকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। আজ (মঙ্গলবার) শাল্লায় গিয়ে তিনি বিষয়টি তদন্ত করবেন। এজন্যে সেখানে জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীও যাবেন। সত্যি যদি দুদকের আসামী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে ঐ কমিটি বাতিল করা হবে। এখন দিরাইয়ের পিআইসি নিয়েও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। দিরাইয়েও তদন্ত হবে। আমরা অবশ্যই অভিযোগ খতিয়ে দেখবো। বাঁধের কাজের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। তিনি বলেন, অনিয়মকারীদের কোনো ছাড় নেই।